আমাদের ডেস্ক:
দুই ঈদ কেন্দ্র করে প্রতি বছর বেপরোয়া হয়ে ওঠে জাল নোটের কারবারিরা। রোজা ও ঈদুল ফিতরে জাল টাকা ছড়িয়ে দিতে এবারও বিভিন্নভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। অনলাইনে পেজ খুলে চালানো হচ্ছে প্রচারণা। দেওয়া হচ্ছে লোভনীয় অফার। দিচ্ছে দেশের যে কোনো প্রান্তে হোম ডেলিভারির সুবিধা। ঈদের মতো বড় উৎসব তাদের প্রধান টার্গেট।
চলতি বছর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে ধরা পড়ে প্রায় এক কোটি টাকা মূল্যমানের জাল নোট। নকল এ টাকা তৈরিতে ব্যবহার করা হয় টিস্যু পেপার, প্রিন্টার, ল্যাপটপ ও প্রিন্টারের কালি। পরে সফটওয়্যারের সাহায্যে মাউসের ক্লিকে মুহূর্তেই একের পর এক বেরিয়ে আসে ৫০, ১০০, ২০০, ৫০০ ও এক হাজার টাকার জাল নোট।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, স¤প্রতি এ চক্রের সদস্যরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা জাল টাকা বিক্রির জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছে। এই চক্রগুলো জাল টাকা তৈরি করে নির্দিষ্ট কয়েকজন সদস্য দিয়ে আসল টাকার ভেতর জাল টাকা মিশিয়ে মানুষকে নিঃস্ব করে দিচ্ছে।
গত ৭ মার্চ এমনই একটি জাল নোট তৈরি চক্রের মূলহোতা পারভেজ হোসাইনসহ চারজনকে গ্রেফতার করে র্যাব। রাজধানীর রূপনগর থানার ইস্টার্ন হাউজিং এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। র্যাব বলছে, বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে জাল টাকা কেনাবেচার নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিলেন তারা। এসব পেজ প্রমোট, বুস্টিং করে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা সংগ্রহ করেন, যারা রমজান ও ঈদুল ফিতর টার্গেট করে জাল নোটের ব্যবসায় লিপ্ত হন। তারা প্রতি এক লাখ টাকা মূল্যমানের জাল নোট ১৫Í২০ হাজার টাকায় বিক্রি করতেন। ঈদ উপলক্ষে জাল নোটের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে তারা প্রতি এক লাখ টাকার জাল নোট ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করছিলেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে দেখা যায়, ঈদ উপলক্ষে বিশেষ অফার দিয়ে ফেসবুক, টিকটক ও ইন্সটাগ্রামসহ অনলাইনে বিভিন্নভাবে বিক্রি করা হচ্ছে জাল নোট। অগ্রিম অর্ডার নিয়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় এজেন্টদের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে হোম ডেলিভারিও।
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, ‘জাল টাকা বিক্রি করি’ নামে একটি ফেসবুকে পেজে স¤প্রতি ১০ টাকা থেকে শুরু করে এক হাজার টাকার জাল নোট বিক্রির পোস্ট দেওয়া হয়েছে। ওই পোস্টে উল্লেখ করা হয়েছেÍ ‘পবিত্র ঈদ সামনে রেখে নিখুঁত ও মসৃণ প্রিন্টসহ সম্পূর্ণ এ গ্রেডের প্রোডাক্ট (জাল নোট) পাওয়া যাচ্ছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কুরিয়ার ও হোম ডেলিভারির ব্যবস্থাও রয়েছে।’
এসব মাধ্যম ঘেঁটে দেখা যায়, এক লাখ টাকার জাল নোট পেতে সব মিলিয়ে খরচ করতে হচ্ছে ১০ হাজার টাকা। তবে সেই ১০ হাজার টাকা একবার দিতে হচ্ছে না। প্রথম ধাপে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা অগ্রিম পাঠালেই দুদিনের মধ্যে কুরিয়ারের মাধ্যমে পেঁৗছে দেওয়া হচ্ছে লাখ টাকার জাল নোট। সেগুলো হাতে পাওয়ার পর বাকি টাকা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পরিশোধ করতে হচ্ছে। তবে বেশি পরিমাণে নোট অর্ডার করলে অগ্রিম টাকা কম দিলেও চলে। দুই লাখ টাকার জাল নোটের জন্য অগ্রিম পরিশোধ করতে হচ্ছে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, বিভিন্ন সময়ে রাজধানীর কদমতলী, ডেমরার বিভিন্ন মার্কেট এলাকায় অভিযান চালিয়ে জাল টাকার কারখানার সন্ধান মেলে। এছাড়া লালবাগ, রামপুরা, মোহাম্মদপুর, কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় জাল নোটের কারখানায় অভিযান চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। একটি সংঘবদ্ধ চক্র নিয়ন্ত্রণ করছে অর্ধশতাধিক গ্রুপ। এর বাইরে আছে আরও অর্ধশতাধিক জাল টাকার ডিলার। প্রত্যেক ডিলারের সঙ্গে কমপক্ষে পাঁচÍছয়জন বাজারজাতকারী আছেন। এসব কারখানায় ভারতীয় রুপিসহ বিভিন্ন দেশের জাল মুদ্রা তৈরি হচ্ছে। ছড়িয়ে পড়ছে দেশÍবিদেশে।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, রাজধানীসহ সারাদেশে অর্ধশতাধিক গ্রুপ জাল টাকা তৈরি ও বিপণনে জড়িত। প্রতিটি উৎসবের আগে জাল নোট তৈরির চক্রগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে। জাল টাকা তৈরি ও বিপণনের কাজে জড়িত চক্রের সদস্যরা তিন ভাগে বিভক্ত। একটি গ্রুপ অর্ডার অনুযায়ী জাল নোট তৈরি করে, অপর গ্রুপ টাকার বান্ডিল পেঁৗছে দেয়, আরেক গ্রুপ এসব টাকা বাজারে ছড়িয়ে দেয়।
গত বছর রাজধানীর পল্লবীতে অভিযান চালিয়ে জাল নোট তৈরি চক্রের মূলহোতা ছগির হোসেনসহ তিনজনকে গ্রেফতার করে র্যাব। এসময় এক কোটি ২০ লাখ টাকা সমমানের জাল নোট উদ্ধার করা হয়। র্যাব জানায়, গ্রেফতার ছগির হোসেন ১৯৮৭ সালে বরগুনা থেকে ঢাকায় আসেন। এসময় ইদ্রিস নামে এক জাল টাকার কারবারির সঙ্গে পরিচয় হয় তার। সেখান থেকেই জাল নোট তৈরিতে তার হাতেখড়ি।
ছগির প্রথমে জাল নোট বিক্রি করতেন। পরে রপ্ত করেন নোট তৈরি। ২০১৭ সালে জাল নোটসহ ইদ্রিস ও ছগির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন। বছরখানেক জেল খেটে বেরিয়ে এসে পুনরায় ২০১৮ সাল থেকে শুরু করেন একই কাজ। কারাগারে গেলেও বেরিয়ে তিনি একই কাজে জড়িয়ে পড়েন।
ডিবির লালবাগ বিভাগের উপÍকমিশনার (ডিসি) মো. মশিউর রহমান সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘বেশিরভাগ জাল নোটের কারবারি ঢাকা শহরে বাসা কিংবা অফিস ভাড়া নিয়ে জাল নোট তৈরি করে। বাসা ভাড়া দেওয়ার আগে মালিকের উচিত প্রত্যেকের এনআইডি কার্ডের কপি সংগ্রহ করে নিকটস্থ থানায় জমা দেওয়া। এছাড়া বাসা ভাড়া নেওয়ার পর ভাড়াটিয়া কী কাজ করছে সেদিকে নজর দেওয়া। সন্দেহজনক কিছু হলেই পুলিশকে খবর দেওয়া।
র্যাবÍ১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোসতাক আহমেদ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘স¤প্রতি জাল টাকা তৈরির সঙ্গে বেশ কয়েকটি চক্র জড়িত বলে র্যাবের গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়। সাধারণ মানুষকে ধেঁাকা দিয়ে অধিক মুনাফার লোভে জাল টাকা তৈরি ও বাজারজাত করার সংঘবদ্ধ কিছু চক্র সক্রিয় হয়ে পড়ছে। মূলত প্রতি বছরই ঈদ সামনে রেখে সক্রিয় হয়ে ওঠে জাল টাকার ব্যবসায়ীরা। এদের গ্রেফতার করা হয়েছে এবং গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে নিয়মিত অভিযান পরিচালিত হচ্ছে।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘যারা জাল নোটের কারবার করে এরই মধ্যে বিভিন্ন সময় গ্রেফতার হয়েছে তাদের ওপর বিশেষ নজরদারি হচ্ছে। র্যাবের সাইবার মনিটরিং টিম সার্বক্ষণিক অনলাইনে নজরদারি করছে। অনলাইনে জাল নোট বিক্রি ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে র্যাব।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (গোয়েন্দা) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, প্রতি ঈদ ও বড় উৎসবের আগে ডিবির স্পেশাল টিম জাল নোটের কারবারিদের ধরতে কাজ করে। এবারও তারা মাঠে কাজ শুরু করছে। জাল নোট যেন বাজারে ছড়াতে না পারে সেজন্য ডিবির সাইবার ইউনিট কাজ করছে।’
জাল নোট চেনার ৬ উপায়
ক্স ১০০, ৫০০ ও ১০০০ টাকাসহ প্রত্যেক নোটের সামনে ও পেছনে দুদিকের ডিজাইন, মধ্যভাগের লেখা, নোটের মূল্যমান এবং সাতটি সমান্তরাল সরল রেখা উঁচুÍনিচুভাবে মুদ্রিত থাকে। ফলে হাত দিলে একটু খসখসে মনে হয়।
অনলাইনে রমরমা জাল টাকার বেচাকেনা, মিলছে হোম ডেলিভারি
ক্স নোটের ডান দিকে ১০০ টাকার ক্ষেত্রে তিনটি, ৫০০ টাকার ক্ষেত্রে চারটি ও এক হাজার টাকার নোটে পাঁচটি ছোট বৃত্তাকার ছাপ আছে, যা হাতের স্পর্শে উঁচুÍনিচু লাগে। এ বৈশিষ্ট্য জাল নোটে সংযোজন করা সম্ভব নয়।
ক্স জাল নোটের জলছাপ অস্পষ্ট ও নিম্নমানের হয়। আসল নোটে ‘বাঘের মাথা’ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মনোগ্রামের স্পষ্ট জলছাপ আছে, যা ভালো করে খেয়াল করলে আলোর বিপরীতে দেখা যায়।
ক্স প্রত্যেক মূল্যমানের নোটেই বাংলাদেশ ব্যাংকের লোগো সম্বলিত নিরাপত্তা সুতা থাকে। নোটের মূল্যমান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের লোগো নিরাপত্তা সুতার চারটি স্থানে মুদ্রিত থাকে।
এ নিরাপত্তা সুতা অনেক মজবুত, যা নোটের কাগজের সঙ্গে এমনভাবে সেঁটে দেওয়া থাকে যে নখের অঁাচড়ে বা মুচড়িয়ে সুতা কোনোভাবেই তোলা সম্ভব নয়। নকল নোটে এত নিখুঁতভাবে সুতাটি দিতে পারে না।
ক্স ১০০, ৫০০ ও ১০০০ টাকা মূল্যমানের প্রত্যেক প্রকার নোটের ওপরের ডান দিকে কোণায় ইংরেজি সংখ্যায় লেখা নোটের মূল্যমান রং পরিবর্তনশীল কালিতে মুদ্রিত থাকে। ফলে ১০০ ও ১০০০ টাকা মূল্যমানের নোট ধীরে ধীরে নড়াচড়া করলে মূল্যমান লেখাটি সোনালি থেকে সবুজ রং ধারণ করে। একইভাবে ৫০০ লেখা লালচে থেকে সবুজাভ হয়। অন্যদিকে জাল নোটে ব্যবহৃত রং চকচক করলেও তা পরিবর্তন হয় না।
অনলাইনে রমরমা জাল টাকার বেচাকেনা, মিলছে হোম ডেলিভারি
ক্স প্রত্যেক প্রকার টাকার নোটে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি, বাংলাদেশ ব্যাংকের মনোগ্রাম ও নোটের মূল্যমান জলছাপ হিসেবে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মনোগ্রাম ও নোটের মূল্যমান প্রতিকৃতির তুলনায় উজ্জ্বল দেখায়। জাল নোটে এসব বৈশিষ্ট্য থাকে না।
এছাড়া স্বল্পমূল্যেও বিভিন্ন ব্র্যান্ডের জাল নোট শনাক্তকারী মেশিন আছে। ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে জাল নোট সহজেই পরীক্ষা করা যায়। জাল নোট ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে দেখলে শুধু একটা রেখা দেখা যাবে।