চার বছর ধরে বন্ধ সেতাবগঞ্জ চিনিকল:নষ্ট হচ্ছে মুল্যবান যন্ত্রপাতি:রূদ্ধ হাজারো মানুষের জীবিকার পথ
দিনাজপুর প্রতিনিধি:
দিনাজপুর জেলার একমাত্র ভারী ও প্রাচীন শিল্প প্রতিষ্ঠান সেতাবগঞ্জ চিনিকলের আখ মাড়াই কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে প্রায় চার বছর ধরে। এতে রূদ্ধ হয়েছে হাজার হাজার মানুষের জীবিকার পথ। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় নষ্ট হচ্ছে মিলের মুল্যবান যন্ত্রাংশ। এরই মধ্যে অন্তবর্তীকালীন সরকার বন্ধ থাকা সেতাবগঞ্জ চিনিকলসহ রাষ্ট্রায়ত্ব ছয়টি চিনিকলের কার্যক্রম আবারও শুরুর চিন্তাভাবনা করছেন। সেতাবগঞ্জ চিনিকল কর্তৃপক্ষ বলছেন—মিলটি চালু করতে কমপক্ষে দুই থেকে তিন বছরের প্রয়োজন। কিন্তু আখচাষীরা বলছেন, কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহন করা হলে এক বছরেই চালু করা সম্ভব দেশের অন্যতম বৃহৎ এই চিনিকলটি।
হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ থাকা সত্বেও ৯০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলার সেতাবগঞ্জ চিনিকলের আখমাড়াই কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয় ২০২০ সালে। এতে কর্মহীন হয়ে পড়ে মিলের শ্রমিক—কর্মচারীরা। জীবিকার পথ রূদ্ধ হয়ে যায় হাজার হাজার মানুষের। প্রাণচাঞ্চল্যহীন হয়ে পড়ে চিনিকলকে কেন্দ্র করে গোটা এলাকা। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় নষ্ট হচ্ছে মিলের মুল্যবান যন্ত্রাংশ।
এরই মধ্যে বর্তমান অন্তবর্তী সরকার দেশের বন্ধ থাকা রাষ্ট্রায়ত্ব ৬টি চিনিকল আবার চালুর চিন্তাভাবনা শুরু করেছে। এরমধ্যে রয়েছে সেতাবগঞ্জ চিনিকলও। কিন্তু সেতাবগঞ্জ চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল বাশার বলছেন—চিনিকলটি চালু করতে কমপক্ষে দুই থেকে তিন বছরের প্রয়োজন।
বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরে তিনি বলেন, আখ মাড়াই মৌসুমের তিন মাস মিলটি চালাতে আখের প্রয়োজন ৯০ হাজার মেট্রিক টন। কিন্তু চলতি মৌসুমে সেতাবগঞ্জ চিনিকলে আখ চাষ হচ্ছে ১ হাজার ২২৪ একর জমিতে। যা থেকে আখ উৎপন্ন হতে পারে ৩০ হাজার মেট্রিক টন। তাই মিলটি চালুর করার আগে আখ উৎপাদনের উপর গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি বলেন, সেতাবগঞ্জ চিনিকলের মোট জমি ৩ হাজার ৮৬০ একর। এর মধ্যে আবাদযোগ্য জমি ২ হাজার ৮৪২ একর।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, মিলটি চালু করতে আখের উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি জনবল নিয়োগ, যানবাহন, যন্ত্রাংশ মেরামতের প্রয়োজন।
তিনি বলেন, মিলটি চালু রাখলে কমপক্ষে ১ হাজার ৯৬ জন কর্মকর্তা—কর্মচারীর প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে কর্মরত রয়েছে (স্থায়ী ও চুক্তিভিত্তিক) ৮৬ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী। আখ মাড়াই বন্ধের পর মিলের যানবাহনগুলো অন্য মিলে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। বর্তমানে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের একটি আর মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)—এর একটি গাড়ী ছাড়া আর কিছুই নেই। যে কয়টি ট্রাক্টর রয়েছে, তা অকেজো হয়ে পড়ে আছে। তাছাড়া দীর্ঘদিন পড়ে থাকার কারনে মিলের অনেক যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। সবকিছু মিলিয়ে মিলটি চালু করতে অন্তত ৫০ কোটি টাকার প্রয়োজন।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল বাশার আরও জানান, ইতিমধ্যেই মিলটি চালুর সম্ভাবনা নিয়ে কৃষি বিভাগ, যান্ত্রিক বিভাগসহ বিভিন্ন বিভাগ থেকে জরিপ কাজ পরিচালনা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই কিছু রিপোর্ট ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।
এদিকে মিল কর্তৃপক্ষ মিলটি চালুর জন্য অন্তত দুই থেকে তিন বছর সময়ের কথা বললেও আখচাষী ও মিল চালুর ব্যপারে আন্দোলনকারীরা বলছেন, কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহন করা হলে মিলটি এক বছরের মধ্যেই অর্থ্যাৎ আগামী ২০২৫—২৬ অর্থ বছর থেকেই চালু করা সম্ভব।
সেতাবগঞ্জ চিনিকল পুনঃ চালুকরণ আন্দোলন কমিটির আহ্বায়ক আখচাষী মোঃ বদরুদ্দোজা বাপন বলেন, মিলটি যে বছর বন্ধ করা হয়, সেবছরই সেতাবগঞ্জ চিনিকলের জমি ও কৃষকদের জমিসহ মোট ৪ হাজার ১২ একর জমিতে আখচাষ করা হয়। মিল বন্ধের ফলে পরবর্তীতে অনেক কৃষকরা আখ চাষ বন্ধ করে দেন। তিনি বলেন, সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত আখ রোপনের সময়। সরকার যদি এখনই মিলটি চালুর ঘোষনা দেয়, তাহলে আখ রোপনের সময় রয়েছে। আগামী মার্চ মাসের মধ্যেই মিলের জমি ও কৃষকরা আখ রোপন করে আগামী ২০২৫—২৬ অর্থবছরে মিলের আখ মাড়াই কার্যক্রম চালু করা সম্ভব। তিনি বলেন, এ জন্য অবিলম্বে মিল চালুর ঘোষনা দিয়ে মিলের জমিতে আখ রোপনের পাশাপাশি কৃষকদের আখ চাষে উদ্ধুদ্ধকরণ কর্মসূচী গ্রহন করতে হবে। বদরুদ্দোজা বাপন বলেন, ‘চিনিকলটি বন্ধ থাকায় এলাকার অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। আমাদের এই অঞ্চল থেকে কোটি কোটি টাকা মানি সার্কুলার হতো। বর্তমানে দারিদ্র্যসীমার নিচে আমরা বাস করছি। অন্য ফসল চাষ করে আখচাষিরা সংসারের খরচ চালাতে পারছেন না। আমাদের একমাত্র প্রাণের দাবি সেতাবগঞ্জ চিনিকল আধুনিকায়ন করে পুনরায় চালু করা হোক। তাহলে এই অঞ্চলের কৃষক, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটবে। এতে করে ব্যবসা—বাণিজ্যেরও প্রসার হবে।
বোচাগঞ্জ উপজেলার বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক শফিকুল আলম বলেন, ১৯৩৩ সালে প্রতিষ্ঠিত সেতাবগঞ্জ চিনিকলটি দিনাজপুর তথা এই অঞ্চলের একমাত্র ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান। এই মিলটি এই এলাকার পরিচয় বহনের পাশাপাশি মানুষের জীবন ও জীবিকার সাথে সম্পৃক্ত। কিন্তু আওয়ামীলীগ সরকার বারবারই মিলটি বন্ধ করে এই এলাকার মানুষের জীবন ও জীবিকার প্রতি কুঠারাঘাত করেছে। দেশের চিনিশিল্পকে ধ্বংস করে দেশকে আমদানী নির্ভর করে কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহলের স্বার্থ রক্ষা করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে সেতাবগঞ্জ চিনিকল বন্ধ করে দেন। এরপর ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান সেতাবগঞ্জ চিনিকল আবার চালু করে এই এলাকার মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি এলাকার প্রাণচাঞ্চল্য ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। পরবর্তীতে ২০২০ সালে আওয়ামীলীগ সরকার আবারও চিনিকলটি বন্ধ করে দিয়ে চিনিকলকে ঘিরে এই এলাকার মানুষকে বেকার করে দিয়েছেন। আমদানী নির্ভরতা কমিয়ে স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়তে সেতাবগঞ্জ চিনিকলসহ আওয়ামীলীগ সরকারের বন্ধ করে দেয়া দেশের ৬টি চিনিকল অবিলম্বে চালুর দাবী জানান বিএনপি’র এই নেতা।
উল্লেখ্য, দেশের সরকারী মোট ১৫টি চিনিকলের মধ্যে ৬টি চিনিকলের আখমাড়াই কার্যক্রম গত ২০২০ সালে বন্ধ করে দেয়া হয়। বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার বন্ধ থাকা এসব চিনিকল চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান ড. লিপিকা ভদ্র আজ রোববার সেতাবগঞ্জ চিনিকল পরিদর্শনে আসছেন।