‘দেশে প্রথম প্লাজমা টেকনোলজি নিয়ে গবেষণা করে সফল রাবি অধ্যাপক ড. তালুকদার'
রাবি সংবাদদাতা:
দেশের প্রধান কৃষিজ শস্য যেমন ধান, গম, আলু, বেগুন ও পালংশাকে প্লাজমা টেকনোলজি প্রয়োগের ফলে বীজের অঙ্কুরোদম, ফসলের উৎপাদন হার বৃদ্ধি, উৎপাদন সময় হ্রাস এবং রোগবালাই দমনে ভূমিকা রেখেছে। সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগে অবস্থিত প্লাজমা সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ল্যাবের গবেষণায় এটি প্রমাণিত হয়েছে।
ল্যাব সূত্রে জানা গেছে, প্লাজমা টেকনোলজি ব্যবহারে দেশের প্রথম এবং একমাত্র গবেষণাগার হলো প্লাজমা সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ল্যাব। এটি ২০০৯ সালে যাত্রা শুরু করে। যেখানে প্লাজমার প্রায়োগিক ব্যবহার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে শিক্ষা ও গবেষণার উন্নয়নে কাজ করা হয়। এটি পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইইই বিভাগের অধ্যাপক ড. মামুনুর রশিদ তালুকদার। প্লাজমা টেকনোলজি প্রয়োগ পদ্ধতির উদ্ভাবকও তিনি।
প্লাজমা টেকনোলজি সম্পর্কে ড. মামুনুর রশিদ তালুকদার বলেন, 'প্লাজমা পদার্থের চতুর্থ অবস্থা-এ কথা সহজভাবে বোঝার জন্য আমরা এক টুকরো বরফ দিয়ে উদাহরণ দিতে পারি। বরফ পানির কঠিন অবস্থা বা প্রথম অবস্থা। বরফকে যদি আমরা তাপ শক্তি দিতে থাকি তাহলে বরফের অণুগুলোর মধ্যে যে বন্ধন রয়েছে তা দুর্বল হয়ে যাবে এবং একসময় বরফ গলে পানিতে পরিণত হবে। এখানে স্বাভাবিক পানি হলো দ্বিতীয় অবস্থা বা তরল অবস্থা। পানিকে যদি আবার তাপ শক্তি প্রয়োগ করা হয় তাহলে পানি বাষ্পে পরিণত হবে। বাষ্প হলো পানির তৃতীয় অবস্থা বা গ্যাসীয় অবস্থা। এখন যদি আমরা আবার বাষ্পকে আরো উত্তপ্ত করতে থাকি তাহলে বাষ্পে যে নিরপেক্ষ পানির অণু রয়েছে তা আর নিরপেক্ষ অবস্থায় থাকবে না। অণুর ভেতর যে পরমাণু থাকে, সেই পরমাণুর ভেতরে নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকা যে ইলেকট্রন রয়েছে, তা যথেষ্ট উত্তাপের কারণে কক্ষপথ থেকে বের হয়ে আসবে। ফলে ইলেকট্রন, আয়ন ও নিরপেক্ষ অণু (বা পরমাণু) সংমিশ্রিত একটি গ্যাস তৈরি হবে। অর্থাৎ শর্তসাপেক্ষে এ আয়নিত গ্যাসকেই প্লাজমা স্টেট বা পদার্থের চতুর্থ অবস্থা বলা হয়ে থাকে।'
গবেষণায় দেখা গেছে, প্রচলিত পদ্ধতিতে ধান বীজের অঙ্কুরোদগম হার ৭৫ শতাংশ। সেখানে প্লাজমা টেকনোলজি প্রয়োগের ফলে ২১ শতাংশ বেড়ে অঙ্কুরোদগম হয় ৯৬ শতাংশ। একইভাবে গম ৭৫ থেকে বেড়ে ৯৫ শতাংশ, বেগুন ৫০ থেকে বেড়ে ৮০ শতাংশ এবং পালংশাকের অঙ্কুরোদগম হার বাড়ে ৭০ থেকে ৯২ শতাংশ পর্যন্ত। এ পদ্ধতি প্রয়োগের ফলে বীজের পরিমাণ কম লাগে, উৎপাদনও বেশি হয় এবং উৎপাদন সময়ও ১০-২০ শতাংশ কম লাগে।
এছাড়া প্রচলিত পদ্ধতিতে বাংলাদেশে ধান বীজের পরিমাণ ২ লাখ ৮৭ হাজার ৫০০ টন প্রয়োজন হয় (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২১ সালের তথ্যানুসারে), সেখানে প্লাজমা টেকনোলজি প্রয়োগের মাধ্যমে ২ লাখ ৪১ হাজার ৫০০ টন বীজ প্রয়োজন হবে। অর্থাৎ ৪৬ হাজার টন বীজ কম লাগবে। একইভাবে গম বীজের ক্ষেত্রে এক লাখ টনের স্থানে ৮৫ হাজার টন এবং বেগুন বীজের ক্ষেত্রে ২৫ হাজার কেজির স্থানে ২২ হাজার কেজি প্রয়োজন হবে।
প্রচলিত পদ্ধতিতে বাংলাদেশে ১১৫ লাখ হেক্টর জমিতে ধান উৎপাদন হয়েছিল ৩৭ লাখ ৬০ হাজার ৮০০ টন (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২১ সালের তথ্য অনুসারে)। সেখানে প্লাজমা টেকনোলজি প্রয়োগের মাধ্যমে ৪৩ লাখ ৮৭ হাজার ৮০০ টন ধান উৎপাদন সম্ভব হবে। অর্থাৎ ৬ লাখ ২৭ হাজার টন ধান উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। একইভাবে গম উৎপাদন ১০ লাখ ৯৯ হাজার টন থেকে ১২ লাখ ৩৪ হাজার টন, বেগুন উৎপাদন ৫ লাখ ৭ হাজার থেকে ৬ লাখ ১৮ হাজার টন, পালংশাক ৫৮ হাজার থেকে ৮৯ হাজার টন এবং আলু ৯৮ লাখ ৮৭ হাজার থেকে ১ কোটি ১২ লাখ ৮৭ হাজার টন উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।
উল্লিখিত গবেষণা প্রবন্ধসমূহ স্প্রিঞ্জর (Springer), এলসেভিয়ার (Elsevier), ইন্সটিটিউট অব ফিজিক্স (Institute of Physics) সহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থাসমূহের জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
প্লাজমা টেকনোলজি প্রয়োগ পদ্ধতির উদ্ভাবন সম্পর্কে ড. তালুকদার বলেন, 'একক তত্ত্বাবধানে ল্যাব থেকে প্লাজমা টেকনোলজি কৃষি গবেষণায় প্রয়োগের প্রথম সফলতা আসে ২০১৫ সালে। গবেষণার প্রথম গবেষক ছিলেন ড. নেপাল চন্দ্র রায়। পরবর্তী সময়ে কয়েকজন শিক্ষার্থীর সহযোগিতায় গবেষণাগারে কৃষি ক্ষেত্রে প্লাজমা টেকনোলজি প্রয়োগের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্লাজমা সোর্স যেমন গ্লাইডিং আর্ক ডিসচার্জ প্লাজমা, ডাইইলেকট্রিক ব্যারিয়ার ডিসচার্জ প্লাজমা, গ্লো ডিসচার্জ প্লাজমা ইত্যাদি তৈরি করা হয়। এ সোর্সগুলো সফলভাবে ব্যবহার করে শস্যের বীজ ট্রিটমেন্ট ও প্লাজমা সক্রিয় পানি প্রয়োগের মাধ্যমে বীজের অঙ্কুরোদগম হার, ফসলের উৎপাদন হার বৃদ্ধি, উৎপাদন সময় হ্রাস এবং রোগবালাই দমনে ভূমিকা রেখেছে।