৩১ আষাঢ়, ১৪৩২ - ১৬ জুলাই, ২০২৫ - 16 July, 2025

হাঁড়িভাঙা আম: কৃষি অর্থনীতিতে নতুন দিগন্ত

3 weeks ago
73


এ.টি.এম মোহসীন:

রংপুরের জিআই পণ্যখ্যাত হাঁড়িভাঙা আম বাজারে আসতে শুরু করেছে। মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে এই আম বিক্রি শুরু করা হয়েছে। আম চাষি ও ব্যবসায়ীরা আশা করছেন প্রায় ২শ’ কোটি টাকার আম বিক্রি হবে রংপুরের বাগানগুলো থেকে। এবারের আম বেশি উৎপাদন হওয়ায় বাজারে দামে কিছুটা মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। তবুও চাষিরা উৎপাদন বেশি হওায় তাতে গড় লাভের আশা করছেন।

রংপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল মিঠাপুকুরের পদাগঞ্জ স্কুল এণ্ড কলেজ মাঠে মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে এই আম বিক্রি শুরুর উদ্বোধন করেন। আম চাষি ও ব্যবসায়ীদের সাথে এক মতবিনিময় সভার মধ্য দিয়ে আম বিপনন শুরু হয়েছে।  প্রতি বছর এই আম জুনের ২০ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে বাজারজাত শুরু হলেও এবার তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে গাছ থেকে আগাম আম পাড়তে শুরু করেছেন চাষি ও ব্যবসায়ীরা। তবে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে আর কয়েকদিন পরে গাছ থেকে আম সংগ্রহের কথা বলা হচ্ছে। তখনই শুরু হবে হাঁড়িভাঙা আমের ভরা মৌসুম।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জেলায় হাঁড়িভাঙা আম আবাদ করা জমির পরিমাণ ১ হাজার ৯১৫ হেক্টর। এর মধ্যে মিঠাপুকুরে ১ হাজার ২৬৮। জেলায় সম্ভাব্য হাঁড়িভাঙা আমের উৎপাদন ধরা হয়েছে ২৯ হাজার ৮৫১ মেট্রিক টন।

আমচাষি, ব্যবসায়ী ও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গড়ে ৫০-৬০ টাকা কেজি ধরলেও হাঁড়িভাঙা আমকে কেন্দ্র করে রংপুরে এ মৌসুমে প্রায় ২০০ কোটি টাকার লেনদেন ছাড়িয়ে যাবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রংপুরের উপপরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, হাঁড়িভাঙা আমের মাধ্যমে রংপুরের কৃষি অর্থনীতি চাঙা হয়েছে। এ বছর আমগাছে মুকুল কম এলেও আমের আকার ও ফলন ভালো হয়েছে। তবে অতিরিক্ত গরমের কারণে নির্ধারিত সময়ের আগে হাঁড়িভাঙা বাজারে এসেছে।

ক্রেতাদের অভিযোগ, বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হওয়ায় কীটনাশকের ব্যবহার বেড়েছে। অথচ এখনও সম্পূর্ণ পরিপক্ব হয়নি হাঁড়িভাঙা আম। নির্ধারিত সময়ের আগেই কৃত্রিমভাবে আম পাকিয়ে বাজারজাত করায় বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি। গাছ থেকে আম সংগ্রহের ৮-১০ দিন আগে অনেকে ছত্রাকনাশক কীটনাশক স্প্রে করেন।

অম চাষিরা বলছেন, হাঁড়িভাঙা আম পাকলে এটি তিন-চার দিনের বেশি রাখা যায় না। সংরক্ষণের কোনো কার্যকর পদ্ধতিও জানা নেই। যদি এই আম সংরক্ষণের সঠিক প্রক্রিয়া জানা থাকত, তাহলে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে প্রচুর পরিমাণে রপ্তানি করা সম্ভব হতো। হাঁড়িভাঙা আম সংরক্ষণের জন্য এ অঞ্চলে একটি বিশেষায়িত হিমাগারের দাবি জানান চাষিরা।

হাঁড়িভাঙা আমের উৎপাদন এলাকা মিঠাপুকুর উপজেলার, পদাগঞ্জ, খোড়াগাছ ও ময়েনপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, হাঁড়িভাঙা আম বাজারজাত করা হচ্ছে। স্থানীয় বাজারে বাগান থেকে আম সংগ্রহ করে প্লাস্টিকের ক্যারেটে ভরা হচ্ছে। পরে সেগুলো দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠাচ্ছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা।

হাঁড়িভাঙার মৌসুমে আমের সবচেয়ে বড় হাট বসে রংপুরের পদাগঞ্জ হাটে। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। গত মঙ্গলবার পদাগঞ্জের হাটে সকাল থেকেই অটোরিকশা, ভ্যান ও পিকআপে করে আসতে থাকে আমের ক্যারেট। অনেককেই হাটের রাস্তায় সাইকেল ও ভ্যানে ক্যারেটে আম নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আম বেচতে দেখা গেছে। ক্রেতাদের সরব উপস্থিতিতে জমজমাট হয়ে উঠেছে আমের বেচাকেনা।

এবার অতিরিক্ত গরমের কারণে আগেভাগেই আম পাড়া শুরু হয়েছে। তবে কেউ কেউ আম পাকাতে স্প্রে মেশাচ্ছেন। এতে হাঁড়িভাঙা আমের প্রকৃত স্বাদ থাকছে না।

আমচাষি ও উদ্যোক্তা মিজানুর রহমান ও মাইনুল ইসলাম বলেন, এবার আবহাওয়া বেশি উত্তপ্ত থাকায় অনেকেই আগেই আম পাড়া শুরু করেছে। আমের আকার বা সাইজ ভেদে প্রতিমণ আম সর্বনিম্ন ১ হাজার ২০০ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৪০০ টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে। সহনীয় তাপমাত্রা থাকলে আমের বাজার কিছুটা বেশি হয় বলেও জানান এই ব্যবসায়ীরা।

শুধু পদাগঞ্জ হাটেই নয়, হাঁড়িভাঙা আমের প্রধান উৎপাদন এলাকা খোঁড়াগাছ, পাইকারহাট, ময়েনপুর, চ্যাংমারী, বালুয়া মাসুমপুর, কুতুবপুর, গোপালপুর, লোহানীপাড়া, রামনাথপুর, কালুপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় হাঁড়িভাঙ্গা আম বিক্রির দৃশ্য দেখা গেছে।

এদিকে রংপুর শহরের কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল সড়ক, সিটি বাজার, লালবাগ, মডার্ন মোড়, ধাপ বাজার, শাপলা চত্বরসহ নগরীর বিভিন্ন হাট-বাজারে উঠতে শুরু করেছে এই আম। হাট-বাজার ছাড়াও পাড়ামহল্লার অলিগলিতে ফেরি করে হাঁড়িভাঙা আম বিক্রি করতে দেখা গেছে।

প্রতিবছর আমচাষি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় করে হাঁড়িভাঙা বাজারে আসার তারিখ ঘোষণা করে জেলা প্রশাসন। তাই মঙ্গলবার আম বিক্রির উদ্বোধনের আয়োজন করা হয়েছিল মঙ্গলবার মিঠাপুকুরের পদাগঞ্জে।

খোঁড়াগাছ ইউনিয়নের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ বলেন, আমবাগানে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক কম ব্যবহার করতে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ, চাষি প্রশিক্ষণ ও প্রদর্শনী করছে কৃষি বিভাগ। বিষমুক্ত আম উৎপাদনে উত্তম কৃষিচর্চা নিয়ে তারা কৃষকদের সঙ্গে কাজ করছেন। আম সংগ্রহের অন্তত ২০-২৪ দিন আগে থেকে কোনো কীটনাশক ব্যবহার না করতে চাষিদের বলা হয়। কিন্তু অতিরিক্ত প্রতিযোগিতার কারণে কীটনাশকের ব্যবহার কমানো যাচ্ছে না।

মিঠাপুকুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মুহাম্মদ সাইফুল আবেদীন বলেন, আগের বছরগুলোতে ১৫ থেকে ২০ জুনের মধ্যে হাঁড়িভাঙা আম বাজারে আনার তারিখ দেওয়া হয়েছিল। সে হিসেবে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে এবার ১৫ জুনের পরে গাছ থেকে আম সংগ্রহের কথা বলা হয়েছে।

উপজেলার অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) মুলতামিস বিল্লাহ বলেন, গাছ থেকে অপরিপক্ক আম পারা ও ফরমালিন মেশানোর ব্যাপারে কোনো অভিযোগ কেউ দেয়নি। কোথাও এটা করে থাকলে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এদিকে জনপ্রিয়তার কারণে মিঠাপুকুর, বদরগঞ্জ ও রংপুর সদর উপজেলার গণ্ডি পেরিয়ে এখন তারাগঞ্জ, নীলফামারী জেলার সদর, সৈয়দপুর, দিনাজপুরের পার্বতীপুর, খানসামা, চিরিরবন্দরসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে হাঁড়িভাঙা আমের বাগান। ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে এসব বাগান।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

// Set maxWidth