কুসংস্কার হলেও আধুনিক যুগে জ্বীন নামিয়ে চলছে কবিরাজি চিকিৎসা
আসাদুল ইসলাম, সুন্দরগঞ্জ:
দশক তিনেক আগে শিক্ষায় পিছিয়ে ছিলেন গ্রামাঞ্চলের মানুষ। ঘাটতি ছিল আধুনিক চিকিৎসা এবং ডাক্তারেও। অসুখ হলেও অনেকের বাড়িতে দেখা যেত কবিরাজ কিংবা ফকিরকে। এখন সময় বদলেছে। বেড়েছে শিক্ষার হার। উন্নত হয়েছে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং রোগনির্ণয় পদ্ধতিও। জেলা, উপজেলা এমনকি গ্রামাঞ্চলের মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছেছে স্বাস্থ্যসেবা। তবুও কুসংস্কার যে পিছু ছাড়ছে না মানুষের। এখনো রোগ সারাতে অনেকেই শরণাপন্ন হচ্ছেন বৈদ্য, কবিরাজ কিংবা ফকিরের কাছে। এসব বৈদ্য কিংবা কবিরাজ রোগ নির্ণয় ও সারাতে হাজির করছেন জ্বীন। ঠিক তেমনই এক কবিরাজের খোঁজ মিলেছে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রাম হাতিবান্ধায়।
জানা যায়, হাতিবান্ধার পল্লী চিকিৎসক মৃত নুরুল হুদার ছেলে সাইফুল ইসলামের ওপর ছোট বেলা থেকে ছিল জ্বীনের আছর। অনেক ফকির কিংবা কবিরাজের মাধ্যমে সেই জ্বীন ছাড়ানোর অনেক চেষ্টাই করেছিলেন বাবা নুরুল হুদা। কিন্তু কিছুতেই সাইফুলের থেতে জ্বীনকে তাড়াতে পারেননি কবিরাজ ও ফকিররা। স্থানীয়রা বলছেন, ফাতেমা নামের সেই জ্বীনই নাকি কবিরাজি শিখিয়েছে সাইফুলকে। দিচ্ছে নানা রোগের চিকিৎসা।
সরেজমিন দেখা যায়, বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি ভ্যান ও অটোরিকশা। ভিতরে নানা বয়সের নরনারীর ভীড়। কেউ বা এসেছেন চিকিৎসা নিতে, আবার কেউ বা রোগীর স্বজন। শিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত, আসছেন সব ধরনের রোগীরা। দূরদূরান্ত থেকে আসা নানা বয়সের রোগীরা এলেও কিন্তু সেখানে নেই কোনো চিকিৎসক। আছেন সাইফুল ইসলাম নামের এক কবিরাজ। ফাতেমা নামের এক জ্বীন হাজির করেন তিনি। করেন রোগনির্ণয় ও দেন চিকিৎসা। রোগ নির্ণয়ের হাদিয়া হিসেবে নেন একশ টাকা।
পাশেই দেখা গেল গ্যালারিতে রাখা নানা ধরনের আয়ুর্বেদ ওষুধ। কবিরাজ তৈরি করছেন বিভিন্ন ওষধি গাছের ছাল-বাকল এবং পাতার ওষুধ। রোগের ধরন অনুযায়ী রোগীকে দেন এসব ওষুধ। তাতেই নাকি ভালো হচ্ছেন বাত, ব্যথা, হাড়ভাঙা-মচকা রোগীরা। ভালো হচ্ছেন নাকি মাথাব্যথা, প্যারালাইসিস, জন্ডিস ও কিডনি রোগীরাও।
দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস্ট্রিক রোগে ভুগছিলেন মিঠাপুকুরের বালারহাটের যুবক মামুন মিয়া। তিনি বলেন, জ্বীন হাজির করে চিকিৎসা দেওয়া কবিরাজের ওষুধ খেয়ে নাকি ভালোই আছেন তিনি! অপর এক বৃদ্ধা বলেন, হাটু ও কোমরের ব্যথাও নাকি নিরাময় হয়েছে তার!
প্যারালাইসিস রোগে ভোগা মধ্যবয়সী এক রোগীর ভাষ্য, আগে হাঁটতে এবং ওপরে হাত তুলতে পারছিলেন না তিনি। জ্বীনের চিকিৎসা নিয়ে এখন হাঁটা-চলা এবং ওপরে হাতও তুলতে পারছেন ওই রোগী।
তাবিজ-কবচ কিংবা কুফরি করেন কি না- জানতে চাইলে কবিরাজ সাইফুল ইসলাম বলেন, না। আমি কোনো তাবিজ-কবজ করি না। কুফরিও করি না। জ্বীনের মাধ্যমে রোগ নির্ণয় এবং তা সারাতে বিভিন্ন ওষধি গাছের ছাল-বাকল ও পাতা দিয়ে ওষুধ তৈরি করি। আর কিছু ওষুধ গাইবান্ধা এবং রংপুর থেকে সংগ্রহ করি। পরে ইউনিয়ন পরিষদের দেওয়া একটি ট্রেড লাইসেন্সও দেখান তিনি।
মানুষকে সচেতন হতে হবে জানিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার কাজী মো. আবু আহসান বলেন, জ্বীন দ্বারা চিকিৎসা ভাঁওতাবাজি ছাড়া কিছুই না। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার সাথে এটার কোনো মিল নেই এবং ভিত্তিহীন। এতে স্বাস্থ্যের কোনো উপকার হবে না। বরং মানুষ কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হবে।
স্বাস্থ্য সচেতন মানুষরা বলেছেন, আধুনিক যুগেও এমন চিকিৎসা মেনে নেওয়া কঠিন। রোগীরা ভালো হচ্ছেন বললেও সত্যি সত্যিই রোগ ভালো হয় কী না তা খতিয়ে দেখতে স্বাস্থ্য বিভাগকে অনুরোধ জানিয়েছেন তারা।