দেশের প্রায় ৪ কোটি মানুষ খাদ্য ঝুঁকিতে
আমাদের ডেস্ক:
একদল মানুষ খাবার পাচ্ছেন না, আরেকদল করছেন অপচয়। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বৈষম্যের এই প্রবণতা অর্থনীতি কিংবা সামাজিক স্থিতিশীলতা দুই দিকের জন্যই ভয়ংকর। আইন করা সম্ভব না হলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে এমন একটি নীতিমালা তৈরি জরুরি, যাতে কোনভাবেই খাবারের অপচয় না হয়।
শহরের প্রান্তিক প্রায় ৪০ লাখ বস্তিবাসীর একজন আয়েশা বেগম। কুমিল্লা পট্টি বস্তিতে প্রতিটি বিকেল গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় তার সংগ্রাম। এ রোজার দিনে ৩ কন্যার পরিবারের জন্য কিছু একটা করতে হবে তার। ইফতারের তখন বেশি সময় বাকি নেই। দু মুঠো ছোলা ভাজি ৫ জনের জন্য বেশ ভালো। এটায় পেট ভরে, দামও কম। তবে পরিবারের কর্তা দিদার হোসেন কাজে যাননি।
সবচে স্বস্তাটারও দাম বেড়েছে অনেক, কিন্তু একটা খেজুর দিয়ে রোজা ভাঙা যেন রেওয়াজ। নিজেদের মতো এভাবে ছোলামুড়ি, শরবতের সন্ধ্যায় আয়েশা—দিদার আর কন্যাদের হাতে ভর করে আসে ইফতার, বিশ্বাসীদের কাছে যা খুব মর্যাদার।
দিদার হোসেন বলেন, 'বাচ্চারা অনেক সময় বিভিন্ন খাবারের আবদার করে। সামর্থ্য যখন থাকে তখন এনে খাওয়াই। আর যখন না থাকে তখন তো কিছু করার থাকে না।'
এ বস্তিবাসীর অন্য বেলার আহারেও নেই জৌলুসের ছিটেফোটা। এই যেমন মূল্যস্ফীতির বাজারে কড়াইল বস্তির জোৎস্না বেগম। সজনে ডালের সঙ্গে ভাজি তার দুই ছেলের সব মিলিয়ে ১১ জনের সংসারের রাতের খাবার, সেহেরিতেও একই।
জোৎস্না বেগম বলেন, 'টাকা পয়সা না থাকলে কি করমু। একটা মাছ কিনতে ২০০—৩০০ টাকা লাগে।'
সব মিলিয়ে এটা স্পষ্ট, বস্তির মতো এমন পরিবেশে থাকা মানুষগুলোর জীবন একেবারেই সহজ নয়। এখানে অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে তাদের জন্য সবচেয়ে বড় সংগ্রাম নিজেদের এবং ঘরের শিশুদের জন্য খাবার যোগাড় করা। কিন্তু শহরের অন্য প্রান্তের চেহারা কিন্তু ভিন্ন। অভিজাত এলাকার একটি রেস্টুরেন্টের বাফেটে প্রায় ১০০ পদ আছে। কোন রকমেই নেই কমতি কিন্তু এখানে স্বভাবগতভাবে খাবার প্লেটে ওঠানোর প্রতিযোগিতা চলে।
পরিবেশকদের হাতে প্লেট ভর্তি খাবার পরিবেশনের জন্য নয়, পরিষ্কারের জন্য থাকে। কিন্তু একেকটি রেস্টুরেন্টে প্রতিদিন কী পরিমাণ খাবারের অপচয় হচ্ছে তার হিসেব পাওয়াটা কঠিন। কারণ রসুই ঘর কিংবা অন্দরে প্রবেশের সুযোগ খুব একটা নেই।
এক রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপক বলেন, অপ্রয়োজনীয়ভাবে খাবার নষ্ট করছে। আমাদের ৩ ঘণ্টা সময় থাকে। অনেকেই মনে করে এ সময়ের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।
অবশ্য খাবারের এ অপচয়ের প্রবণতা বিশ্বব্যাপী শঙ্কাজনক। চলতি বছরে প্রকাশিত জাতিসংঘের খাবার অপচয় সূচক প্রতিবেদন বলছে, বিশ্ববাজারে আসা ৫ ভাগের একভাগ খাবারই অপচয় করেন সামর্থবান ভোক্তারা। যার পরিমাণ বছরে প্রায় ১০০ কোটি টন এবং বাংলাদেশে এ অপচয়ের হার উন্নত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা রাশিয়ার চেয়েও বেশি।
কিন্তু যেখানে ৪ কোটির বেশি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকিতে সেখানে এই প্রবণতা কতটা নেতিবাচক।
সার্কিট হাউজ জামে মসজিদের খতিব বলেন, 'আল্লাহ অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না। যে খাবার নষ্ট করে সে প্রকৃত মুমিন হতে পারেননি। তাই আমরা যেন খাবার অপচয় না করি।'
অর্থনীতি বিশ্লেষক ড. মাহফুজ কবির বলেন, 'আমাদের উৎপাদন হচ্ছে ঠিকি। কিন্তু আপচয়ের কারণে আমদানিও করতে হচ্ছে। এ অপচয় না হলে আমরা বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করতে পারতাম। এ বিষয়ে সরকারের কোনো সচেতনতামূলক কর্মসূচিও নেই।'
বাস্তবতা হলো খাবারের অপচয় অপরাধ বাংলাদেশের আইনে এমন কোন দিক নেই। তাই বিশ্লেষকরা মনে করেন খাবার পাবার শঙ্কায় থাকার মানুষগুলোর স্বার্থে একটি নীতিমালা হোক। সামাজিক কিংবা বিশ্বাসের প্রচারে এমন একটা অনুভূতি সঞ্চারিত হোক যার চূড়ান্ত লক্ষ্য বৈষম্যহীন এক বাংলাদেশ।