আ.লীগ কর্মী এখন বিএনপির ওয়ার্ড সাংগঠনিক সম্পাদক : বদরগঞ্জে সমালোচনার ঝড়

বদরগঞ্জ (রংপুর) প্রতিনিধি:
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দলবদল নতুন না হলেও, রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার রাধানগর ইউনিয়নের সাম্প্রতিক একটি ঘটনা রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। আওয়ামী লীগের একজন অতি সক্রিয় কর্মী জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির ২নং ওয়ার্ডের সাংগঠনিক সম্পাদক হয়ে যাওয়ায় দলের তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা। সমালোচনার ঝড় উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। আলোচিত ওই ব্যক্তির নাম নজিবুর ইসলাম। তাঁর বাড়ি রাধানগর ইউনিয়নের দিলালপুর ছাতারপাড়া গ্রামে। দীর্ঘদিনের আনুগত্য স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মী ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের তথ্য বলছে, নজিবুর ইসলাম কেবল নামেই আওয়ামী লীগ কর্মী ছিলেন না, তিনি ছিলেন দলটির একজন একনিষ্ঠ প্রচারক। তিনি নিয়মিতভাবে বদরগঞ্জ-তারাগঞ্জ আসনের সাবেক আওয়ামী লীগের দলীয় এমপি ডিউক চৌধুরীর পক্ষে প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছেন। এমনকি, সর্বশেষ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যানের নৌকা মার্কার প্রার্থী কামাল কুঠিয়ালের নির্বাচনী প্রচারেও তার সরব উপস্থিতি ছিল।
অভিযোগ রয়েছে, তিনি 'সুখপাখি' ও 'নজিবুর ইসলাম' নামে দুটি ফেসবুক আইডি পরিচালনা করে আওয়ামী লীগের পক্ষে জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে নৌকা মার্কার প্রার্থীদের জন্য ভোটের প্রচার চালাতেন। সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগটি হলো, ২০২৪ সালের ভোটারবিহীন পাতানো নির্বাচনে তিনি ভোট কেন্দ্রে প্রকাশ্যে নৌকা মার্কার পক্ষে সিল মারেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবিতে দেখা যায়, তিনি বিভিন্ন সময়ে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান, স্বৈরাচার সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সজীব ওয়াজেদ জয়ের ছবি সংবলিত পোস্টার ব্যবহার করে নির্বাচনী প্রচার ও আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী কামাল কুঠিয়ালের প্রচারনা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের প্রভাব বিস্তার করেছেন, যা তার দীর্ঘদিনের আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টতার অকাট্য প্রমাণ। তাঁর এমন দীর্ঘদিনের আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টতা থাকার পরও সম্প্রতি তিনি বিএনপির ২ নং ওয়ার্ডের সাংগঠনিক সম্পাদক পদ পাওয়ায় স্থানীয় বিএনপির তৃণমূলের কর্মীদের মাঝে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক যুবদল,কৃষক দল,ছাত্রদল,সেচ্ছাসেবক দল,এমন কি সাধারণ সদস্য ও নেতাকর্মীরা এই পদায়নকে মেনে নিতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন।
তৃণমূল নেতাকর্মীরা বলছেন জেল-জুলুম সহ্য করে কী পেলাম? নজিবুর ইসলামের এমন অপ্রত্যাশিত পদায়ন রাধানগর ইউনিয়নের বিএনপি কর্মী ও সমর্থকদের হতাশ করেছে। দুঃসময়ে যারা দলের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাদের বঞ্চিত করে একজন 'অনুপ্রবেশকারীকে' গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক পদ দেওয়ায় তারা ক্ষোভে ফুঁসছেন। রাধানগর ইউনিয়ন বিএনপি’র সদস্য রুহুল আমিন তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, "আমরা দিনের পর দিন মিথ্যা মামলায় জর্জরিত হয়েছি, জেল-জুলুম সহ্য করেছি। অথচ এখন আওয়ামী লীগের লোককে এনে সাংগঠনিক সম্পাদক বানানো হচ্ছে। এটা ত্যাগী কর্মীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা।" রাধানগর ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল হক এই সিদ্ধান্তকে 'অশুভ' আখ্যা দিয়ে বলেন, "যে লোক নৌকার পক্ষে প্রকাশ্যে ভোট দিল, সে কীভাবে ধানের শীষের ওয়ার্ড সাংগঠনিক সম্পাদক হয়? এর ফলে সাংগঠনিক কাজ মুখ থুবড়ে পড়বে এবং দলের প্রতি সাধারণ কর্মীদের আস্থা কমবে।" রাধানগর ইউনিয়ন বিএনপি ২ নং ওয়ার্ডের সদস্য ও স্বেচ্ছাসেবক সম্পাদক মেহেদী হাসান রানা প্রশ্ন তোলেন, "এত বড় একজন অনুপ্রবেশকারীকে পদ দেওয়ার পেছনে কোনো আর্থিক লেনদেন বা রাজনৈতিক চাপ আছে কি না, তা তদন্ত করা উচিত।"
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে নাজিবুর ইসলাম বলেন, আমি কখনো আওয়ামী লীগ করিনি। আমার বিরুদ্ধে হিংসাত্মকভাবে মিথ্যা অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের মিছিল-মিটিংয়েও আমি কখনো যাইনি। অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই।
বিতর্ক যখন তুঙ্গে, তখন এ বিষয়ে স্থানীয় ও জেলা বিএনপির নেতাদের বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়। রাধানগর ইউনিয়নের সভাপতি নুরুজ্জামান প্রামাণিক স্বীকার করেন, "কমিটি গঠনের সময় তার অতীত কর্মকাণ্ড সঠিকভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। এই পদায়নের কারণে তৃণমূলের মধ্যে যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে, তা আমরা উপলব্ধি করছি। দ্রুতই আমরা বিষয়টি নিয়ে অভ্যন্তরীণ আলোচনা করে একটি সঠিক সিদ্ধান্ত নেব। উপজেলা বিএনপির সভাপতি অধ্যাপক পরিতোষ চক্রবর্তী এই ঘটনাকে 'দুর্ভাগ্যজনক ভুল' আখ্যা দিয়ে বলেন, "আমরা অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে বিশ্বাসী। যদি তদন্তে প্রমাণিত হয় যে তিনি আওয়ামী লীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন, তবে তার পদ তাৎক্ষণিকভাবে বাতিল করা হবে। দলের ত্যাগী কর্মীদের মর্যাদা সবার আগে। জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আনিছুর রহমান লাকু ঘটনাটিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখার কথা জানিয়ে বলেন, "দলের আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো কাজকে আমরা প্রশ্রয় দেব না। আমরা ইতিমধ্যে উপজেলা কমিটির কাছে দ্রুত ব্যাখ্যা তলব করেছি। এটি নিঃসন্দেহে সংগঠনের নীতির চরম লঙ্ঘন। প্রয়োজনে জেলা কমিটি সরাসরি হস্তক্ষেপ করে এই বিতর্কিত পদায়ন বাতিল করবে।"
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির কমিটি গঠন প্রক্রিয়ায় সততা ও স্বচ্ছতার অভাব থাকলে তা দলের সাংগঠনিক কাঠামোকে আরও দুর্বল করে দিতে পারে। এই ঘটনা বদরগঞ্জের রাজনীতিতে 'অনুপ্রবেশ ইস্যু'-কে নতুন করে সামনে এনে দিয়েছে। এই ঘটনা বদরগঞ্জের রাজনীতিতে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে - দলের আদর্শ ও কর্মীদের প্রতি আনুগত্য যাচাইয়ে কমিটি গঠনের প্রক্রিয়াটি কতটা ত্রুটিমুক্ত? স্থানীয় বিএনপির মধ্যে এই 'অনুপ্রবেশের' ঘটনা নিয়ে উত্তেজনা বিরাজ করছে।