২২ অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ - ০৬ ডিসেম্বর, ২০২৫ - 06 December, 2025

কুড়িগ্রামের জিণ্জিরাম নদীর ভাঙ্গনে চারশত পরিবারের বেঁচে  থাকার লড়াই

2 days ago
66


আহসান হাবীব নীলু, কুড়িগ্রাম:

বকবান্ধা ব্যাপারী পাড়ায় স্হানীয়দের উদ্যোগে স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত বাঁশের বান্ডাল ও বালু ভর্তি জিও ব্যাগ দিয়ে জিণ্জিরাম নদীতে প্রতিরোধ গড়ায় নদীর আগ্রাসন থেকে রক্ষা পেয়েছে প্রায় ৪০০ পরিবার। ভিটে বাড়ি রক্ষায় স্হায়ী বাধঁ নির্মানের দাবি ভুক্তভোগী স্হানীয়দের।

কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী উপজেলার সায়দাবাদ ঘাট থেকে বকবান্ধা ব্যাপারীপাড়া যেতে নৌকায় লাগে প্রায় ৪০ মিনিট। সড়কপথ নেই বললেই চলে। ভারতের আসাম থেকে নেমে আসা জিঞ্জিরাম নদী এখানকার মানুষের জীবন–জীবিকার প্রধান ভরসা। দুই তীরজুড়ে সরিষা, মাসকলাই ও ভুট্টার খেত, আর নদীতীরে টানানো জালই বলে দেয়—নদীকেন্দ্রিক জীবনই তাঁদের বাস্তবতা। কিন্তু এই নদীই মাঝে মাঝে হয়ে ওঠে ভয়ংকর। নদী ভাঙ্গনে নিঃস্ব অনেক পরিবার।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উজানে অতিবৃষ্টি বা সামান্য বৃষ্টিতেই পাহাড়ি ঢল নেমে ভাটিতে নদী আগ্রাসী হয়ে ওঠে। যাদুরচর ইউনিয়নের বকবান্ধার বহু ঘরবাড়ি, জমিজমা, বছরের পর বছর ধরে ভাঙনে হারিয়ে গেছে। স্থানীয়দের কাছে নদীভাঙন নতুন নয়। ফি বছরের ভাঙ্গনে ক্রমেই বদলে যাচ্ছে এ জনপদের মানচিত্র। সরকারের কার্যকরী উদ্যোগ না থাকলেও গতবছর ২০২৪ সালের শেষ দিকে স্থানীয়দের নিয়ে শুরু হওয়া এক উদ্যোগ বদলে দেয় তাঁদের আশঙ্কা।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আরডিআরএস বাংলাদেশের ট্রোসা-২ প্রকল্পের সহায়তায় নদীতীরের মানুষ ‘নদী বৈঠকে’ বসে সিদ্ধান্ত নেন—বড় বাঁধ নয়, দ্রুত কার্যকর ও কম খরচের সমাধান হিসেবে বাঁশের বান্ডাল বসানো হবে। স্থানীয়দের চাঁদা, ইউনিয়ন পরিষদের অনুদান ও প্রকল্পের কারিগরি সহায়তায় ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে ৬০০ মিটার এলাকায় ২৭টি বাঁশের বান্ডাল বসানো হয়। এতে স্রোতের চাপ তীরে কমে আসে।

তবে শুধু বান্ডাল যথেষ্ট নয়—এ কথা বুঝতে সময় লাগেনি। বর্ষার স্রোত ও নৌযান চলাচলে বান্ডাল দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই ৪ জুন স্থানীয় ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল পানি উন্নয়ন বোর্ডে জিও ব্যাগের আবেদন জমা দেয়। জুলাইয়ে জিও ব্যাগ সরবরাহ হলে স্বেচ্ছাশ্রমে স্থানীয়রা বান্ডালের পাশে আরও শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করেন।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাঁশের বান্ডাল ঘিরে জিঞ্জিরাম তীরে সবজি লাগাচ্ছেন

ব্যাপারী পাড়ার আকিয়া বেগম(৬৫) জানান, গত এক বছরে ২ বিঘা জমি ভাঙি নিছে। রান্না ঘর ভেঙে আঙিনায় ভাঙন নাগছিলো পরে  বান্ডাল দেওয়ায় ভাঙন থেমেছে। একই এলাকার আতাউর রহমান (৫৫) ও আহম্মদ আলী (৬০) জানান, স্হানীয় উদ্যোগে এবং স্বেচ্ছাশ্রমে গড়া বান্ডালেের কারণে এবার তারা নদী ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।  কমেছে আতংক।

আনজু বেগম (৫০)। তিনি জানান, ‘ধনি–গরিব সব ঘর থেইকা টাকা তুলছি—১০ টাকা হোক আর হাজার টাকা। এভাবে ৫০ হাজার টাকা ওঠে। ইউনিয়ন পরিষদ আরও ১ লাখ টাকা দেয়। স্বেচ্ছাশ্রমে বান্ডাল বানাইছি।’

নাহিদ হাসান (৪০) বলেন, এ বছর ভাঙন থেকে অন্তত ৪০০ পরিবার রক্ষা পেয়েছে ।

প্রবীণ বাসিন্দা গুলু মিয়া (৭০) বলেন, ‘বাপ-দাদার ১০ বিঘা জমি আছিল। ভাঙতে ভাঙতে এহন শুধু বসতভিটা আছে। বান্ডাল দেওনের পর এ বছর আর ভাঙে নাই।’

স্থায়ী বাঁধ না থাকায় বকবান্ধা নামাপাড়া ও ব্যাপারীপাড়ার প্রায় ৪০০ পরিবারের প্রায় ২ হাজার মানুষ এখনো ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে। হুমকিতে আছে স্থানীয় বাজার, দুটি মসজিদ, একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ঈদগাহ মাঠ ও কবরস্থান।

বকবান্ধা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ময়নাল হক বলেন, ‘উজানে ভারি বৃষ্টি মানেই ভাটিতে দুশ্চিন্তা। স্থায়ী বাঁধ দরকার। বান্ডাল নির্মাণের ফলে চলতি বছর এখানকার মানুষ নদীর আগ্রাসন থেকে রক্ষা পেয়েছে।

ট্রোসা-২ প্রকল্পের সহকারী কর্মকর্তা আবদুর রহিম খন্দকার বলেন, ‘স্থানীয়দের উদ্যোগকে টেকসই করতে আমরা আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিয়েছি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের জিও ব্যাগ, প্রকল্পের পরামর্শ আর স্বেচ্ছাশ্রম—এই তিন মিলেই এখন তীরটা ভাঙনমুক্ত।’

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী  রাকিবুল হাসান বলেন, ‘স্থানীয় চাহিদার ভিত্তিতে জরুরি জিও ব্যাগ সরবরাহ করেছি। স্থানীয়রা স্বেচ্ছাশ্রমে জিও ব্যাগ ও বাঁশ দিয়ে টেকসই বান্ডাল তৈরি করেছে। আমরা উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে বরাদ্দ চেয়েছি। বরাদ্দ পেলে স্হায়ী বাধের ব্যাবস্হা করা হবে।

বাঁশের বান্ডাল ও জিও ব্যাগের সমন্বয়ে জিঞ্জিরাম তীরে এবার কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে। তবে স্থানীয়দের দাবি- স্থায়ী বাঁধ না হলে এই স্বস্তি টেকসই হবে না।

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

// Set maxWidth