চাষিরা বলছেন মুকুল কম কৃষি বিভাগ দেখছে বাম্পার ফলন
রাজশাহী প্রতিনিধি:
আমের কথা উঠলেই রাজশাহীর নাম আসবে অবধারিতভাবেই। সারা দেশের আমের চাহিদার একটি বড় অংশ মেটায় এই জেলা। তাতে বছরে আমের ব্যবসা ছাড়িয়ে যায় হাজার কোটি টাকা। আম তাই রাজশাহীর একটি অন্যতম অর্থকরী ফসলও। সেই আমের গাছে গাছে এখন মুকুল থেকে ফুটেছে গুটি। সেসব গুটি রাজশাহীর হাজারও আম চাষির স্বপ্ন হয়ে এখন গাছে ঝুলছে।
রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকায় এখন আমের মুকুল আর গুটির ঘ্রাণ আকাশে—বাতাসে। চৈত্রের প্রখর তাপ বাড়তে থাকায় মুকুল থেকে গুটি আসতে শুরু করেছে। জেলার বাঘা উপজেলার গাছগুলোতে সবচেয়ে বেশি গুটি এসেছে। গাছ পরিচর্যায় তাই ব্যস্ত সময় কাটাতে হচ্ছে চাষিদের।
আমের আবাদ ঘিরে গড়ে ওঠা স্বপ্ন অবশ্য এবার খুব স্বস্তি দিচ্ছে না আম চাষিদের। তারা বলছেন, গত কয়েক বছরের মধ্যে এবারই সবচেয়ে কম মুকুল এসেছে। তাতে ফলন নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগছেন তারা। তবে কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। তাদের দাবি, এবার আমের মুকুল খুব ভালো হয়েছে। তাই আমের বাম্পার ফলন প্রত্যাশা করছেন তারা।
এ বছর রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও নাটোর এই চার জেলায় ৯৩ হাজার ২৬৬ হেক্টর জমিতে আম চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি স¤প্রসারণ অধিদফতর। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় সাড়ে ১২ লাখ টন। গত বছর এই অঞ্চলে মোট ১২ লাখ সাত হাজার ২৬৩ টন আম উৎপাদন হয়েছিল। সে হিসাবে গত মৌসুমের তুলনায় ৪৩ হাজার টন বেশি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে আমের।
আম চাষিরা বলছেন, এ বছর মুকুল তুলনামূলকভাবে কম এসেছে। এর জন্য আবহাওয়াকে দায়ী করছেন কেউ কেউ।
রাজশাহী জেলা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য বলছে, গত বছর রাজশাহীতে ১৯ হাজার ৫৭৮ হেক্টর জমির বাগানে আম চাষ হয়েছিল। এর আগের বছর ১৮ হাজার ৫১৫ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছিল। গত বছর উৎপাদন হয়েছিল দুই লাখ ২৫ হাজার ৯১২ মেট্রিক টন। আগের কয়েক বছরে প্রতিবছরই উৎপাদন বেড়েছে আমের। সে হিসাবে এবারও আমের উৎপাদন বাড়বে বলে আশা করছেন অধিদফতরের কর্মকর্তারা। বলছেন, প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ না হলে এবার আমের বাম্পার ফলন হবে। কৃষকরা আমের মুকুল কম এসেছে বলছেন এ নিয়ে তাদের কোনো ভ্রম্নক্ষেপ নেই।
রাজশাহী জেলার বাঘা ও চারঘাট উপজেলায় সবচেয়ে বেশি আম চাষ হয়। চারঘাট ও বাঘার কিছু এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সব গাছেই আমের মুকুল আছে। যেসব গাছে আগাম মুকুল এসেছিল, সেগুলোতে ফলও ধরতে শুরু করেছে। মুকুল থেকে ফল হওয়ার প্রাথমিক এই ধাপকে বলা হয় গুটি। সেসব গুটির পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় কাটছে চাষিদের।
চাষিরা জানিয়েছেন, আগাম মুকুলগুলোতে প্রথমে গুটি আসতে শুরু করেছে। পর্যায়ক্রমে ফজলি, আশ্বিনা, দুধসর ও হিমসাগরের গুটি আসবে। এসব জাতের আমের কিছু কিছু গাছে গুটি আসতেও শুরু করেছে। পোকামাকড় যেন গাছে ভিড়তে না পারে, সেজন্য এখন ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। তবে সার্বিকভাবে এবার মুকুল কিছুটা কম বলে জানালেন চাষিরা।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় ঘুরে দেখা যায়, চব্বিশনগর ও দরগাপাড়া এলাকার আম বাগানগুলোতেও গুটি ধরতে শুরু করেছে। তবে এই উপজেলাতেও আম গাছে প্রত্যাশিত পরিমাণে মুকুল না আসার কথা জানাচ্ছেন চাষিরা।
দরগাপাড়া গ্রামের আম চাষি শামীম আখতার সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের গ্রামের কিছু গাছে গুটি এসেছে। কিন্তু ৪০ শতাংশ গাছে মুকুল ঠিকমতো আসেনি। কিছু গাছের মুকুল ফল না ধরেই শুকিয়ে যাচ্ছে।’ এ বছর পরাগায়নের জন্য এখনো যথেষ্ট মৌমাছি দেখা না যাওয়ার কারণেই এ পরিস্থিতি বলে মনে করছেন তিনি।
বাঘা উপজেলার আম উৎপাদক শফিকুল ইসলাম রফতানিকারকদের জন্য আম সরবরাহ করেন। তিনি আবার মুকুলের স্বল্পতার জন্য দায়ী করছেন আবহাওয়াকে। শফিকুল সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘৩০০ বিঘা জমির আম বাগান। ৫০ শতাংশ গাছে মুকুল ঠিকমতো আসেনি। আবহাওয়ার জন্যই এ রকম হয়েছে। আম গ্রীষ্মকালের ফল। কিন্তু কিছুদিন আগেও রাতে বেশ শীত অনুভব হচ্ছিল।’
বাগান পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন বাঘা উপজেলার খায়ের হাট গ্রামের আম চাষি মাসুদ রানা। তার গাছগুলোতে অবশ্য ভালো মুকুল এসেছে বলে জানালেন। বলেন, ‘তিন বিঘা জমিতে আমের বাগান আছে আমার। প্রতিটি গাছে ব্যাপক মুকুল এসেছে। পোকামাকড় দমনের জন্য এখন ওষুধ ও কীটনাশক ছিটানো হচ্ছে। আশা করছি, ভালো ফলন হবে।’
মুকুলের পরিমাণ নিয়ে আম চাষিদের মধ্যে অসন্তোষ থাকলেও আগের বছরের তুলনায় ভালো মুকুল এসেছে বলে মনে করছেন বাঘা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিউল্লাহ সুলতান। আবহাওয়া ভালো থাকলে বাম্পার ফলনের প্রত্যাশাও করছেন তিনি।
শফিউল্লাহ সুলতান সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘উপজেলায় আট হাজার ৩৬৮ হেক্টর জমিতে আম বাগান রয়েছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষ বাড়ানো হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এ বছর এক লাখ ১০ হাজার টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে উপজেলায়। আশা করছি, সবকিছু ঠিক থাকলে বাম্পার ফলন হবে এবং লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে।’
বিশেষজ্ঞরা অবশ্য চলমান আবহাওয়াকে আমের জন্য খুব বেশি উপযুক্ত মনে করছেন না। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলিম উদ্দিন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘গ্রীষ্মকালীন ফল আম উচ্চ তাপমাত্রা পছন্দ করে। তবে চাষের সময় খুব বেশি তাপমাত্রা ভালো নয়। মুকুল ও গুটি আসার সময়ের আদর্শ তাপমাত্রা ১৫ থেকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু বর্তমানে দিনের তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে যাচ্ছে, আবার রাতের তাপমাত্রা ১৩ ডিগ্রির আশেপাশে নেমে যাচ্ছে। এই চরম ওঠানামা মুকুল ও গুটির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।’
পরাগায়নের জন্য মৌমাছি কম আসা নিয়ে কৃষকদের বক্তব্য প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ড. আলিম বলেন, ‘আমের পরাগায়নে সহায়ক মাছি, প্রধানত সিরফিড মাছি। এই মাছি শুধু গ্রীষ্মকালেই দেখা দেয়। এর চেহারা মৌমাছির মতো বলে চাষিরা সিরফিড মাছিকেই মৌমাছি বলে ডাকে। কোনো কারণে এই মাছির উপস্থিতি কম হলে মুকুল কম হতে পারে।’