২৭ আশ্বিন, ১৪৩২ - ১২ অক্টোবর, ২০২৫ - 12 October, 2025

ডিমলায় কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না অবৈধ মিনি পেট্রোল পাম্প

12 hours ago
14


ডিমলা (নীলফামারী) প্রতিনিধি:

নীলফামারীর ডিমলায় অবৈধভাবে গড়ে ওঠা অসংখ্য মিনি পেট্রোল পাম্প গড়ে ওঠায় সম্প্রতি উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুইটি মিনি পেট্রোল পাম্পে অভিযান চালিয়ে নামমাত্র জড়িমানা করে । প্রশাসনের গাফিলতির কারণে কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না অবৈধ মিনি পেট্রোল পাম্পগুলো। সে কারনে নিরাপত্তাহীনতা ও চরম জীবনের ঝুঁকিতে ডিমলাবাসী। এগুলো যেন এক একটি জ্বলন্ত বারুদের স্ফিঙ্গ। এ অবৈধ প্রতিষ্ঠানগুলো গোটা উপজেলাকে দখল করে বসে আছে। উপজেলা জুড়ে অনুমোদনহীন অন্তত প্রায়় ৭০ টি মিনি পেট্রোল পাম্প রয়েছে। এসব মিনি পাম্পে প্রতিদিন ব্যবহার করা হচ্ছে অত্যাধুনিক ডিসপেনসার মেশিন, বিক্রি হচ্ছে ডিজেল, পেট্রোল ও অকটেন সহ অন্যান্য দাহ্য পদার্থ। এসব অবৈধ কার্যক্রমে সরকারী ভাবে নেই কোন অনুমোদন, অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা কিংবা পরিবেশগত ছাড়পত্র।

এলাকাবাসী সর্বদাই আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করছে, যে কোন সময় ঘটে যেতে পারে ভয়াবহ দুর্ঘটনা । উপজেলা প্রশাসন এসব ঝুঁকিপূর্ণ অবৈধ মিনি পেট্রোল পাম্পগুলো বন্ধ করে দেয়ার কথা বললেও  বাস্তবে কোন কার্যকরী ভূৃমিকা রাখছেন না মিনি পাম্প মালিকরা। এলাকাবাসীর দাবি, দ্রুততম সময়ের মধ্যে অবৈধ মিনি পেট্রোল পাম্পগুলো বন্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে উপজেলা প্রশাসন।

ইতিমধ্যেই ডিমলা সদর ইউনিয়নের বাবুরহাট বাজার সংলগ্ন টিএনটি সড়কে অবস্থিত ''মেসার্স বক্কর অ্যান্ড সন্স'' নামক একটি অনুমোদনহীন মিনি পাম্পে ঘটে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড। আগুনে দগ্ধ হন শ্রাবণ কুমার রায় (১৮) নামের এক তর তাজা তরুন। সেই সঙ্গে পুড়ে যায় দোকানঘর, অটো শোরুম ও অন্যান্য গালামাল সামগ্রী। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় কোটি টাকা। বিস্ফোরণের বিকট শব্দে পুরো বাজার জুড়ে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়।

দেখা গেছে,  মিনি পাম্পেগুলোর বেশিরভাগই স্থাপিত হয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে জনবহুল ও আবাসিক ভবন নির্মাণ সংলগ্ন এলাকায়। বাজার এলাকার যেখানে বেশি লোকসমাগম, স্কুলের পাশে, সড়কের ধার ঘেঁষে টিনশেড ঘর কিংবা মুদি দোকানে । এই সব স্থানে কোনো ধরনের অগ্নিনির্বাপকের ব্যবস্থা নেই । নেই বালুর বস্তা কিংবা নিরাপদ দূরত্বের ন্যূনতম ব্যবধান । চলাচলের রাস্তায় রাখা হয় বিশাল তেলের ড্রাম, যেকোনো সময় সিগারেটের আগুন বা অন্য কোন কারনে বিস্ফোরিত হয়ে বড় ধরনের অগ্নিকান্ডের দুর্ঘটনা ঘটে ধ্বংস করে দিতে পারে ঐ সব এলাকা।

অনেক মোটর সাইকেল আরোহী জানান, এসব পাম্পে বিক্রি হওয়া তেলে বেশির ভাগই  ময়লা মিশ্রিত, নিম্নমানের ও ভেজাল । যার কারনে যানবাহনের ইঞ্জিন দ্রুত নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এছাড়া পাম্পগুলোতে পরিমাপেও তেল কম দেয়া হয়ে থাকে। এভাবে সাধারণ ভোক্তারা আর্থিকভাবে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত, তেমনি জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশও হুমকির  মুখে পড়েছে ।

বাংলাদেশে জ্বালানি তেল সংরক্ষণ ও বিক্রয় ১৯৩৪ সালের এক্সক্লুসিভ আইন এবং ১৯৩৭ সালের পেট্রোলিয়াম বিধান অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ব্যবসার জন্য বিস্ফোরক অধিদপ্তরের অনুমোদন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে । তাছাড়াও প্রয়োজনীয় অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা, পরিবেশগত ছাড়পত্র এবং সুনির্দিষ্ট নিরাপত্তা মান পূরণে যথাযথ শর্ত আরোপ করা হলেও  ডিমলার মিনি পাম্প ব্যবসায়ীরা এগুলোর কোন কিছুই মানছে না । অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, মিনি পেট্রোল পাম্প ব্যবসায়ীরা শুধুমাত্র ট্রেড লাইসেন্স অথবা স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসা চালিয়ে বিপদ জনক  পরিবেশ তৈরি করেছে। যেটা সম্পূর্ণ বেআইনি ও প্রচলিত আইনের পরিপন্থী  ।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) সূত্র জানায়, ডিমলায় অনুমোদিত ফিলিং স্টেশন রয়েছে মাত্র চারটি। উপজেলা সদরে দুটি এবং খালিশা চাপানি ও ঝুনাগাছ চাপানি ইউনিয়নে একটি করে। কিন্তু বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। উপজেলা জুড়ে ছড়িয়ে আছে অন্তত প্রায় ৭০টির বেশি অবৈধ মিনি পেট্রোল পাম্প।

উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে কিছু দিন পূর্বে ২/১ মিনি পেট্রোল পাম্পে  মোবাইল কোর্ট অভিযান চালানো হলেও তা লোক দেখানো ও দায়সারা মাত্র। এগুলোতে তেমন একটা প্রভাব পড়েনি। কয়েক দিন বন্ধ থাকার পর সেটিও আবার চালু করে দিব্যি ব্যবসা চালাচ্ছেন। প্রশাসনের নীরবতার ও গাফিলতির কারনে ব্যবসায়ীরা আরও বেশী বেপরোয়া হয়ে উঠছে ।

উপজেলা সদরের ব্যাবসায়ী নুর হোসেন বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত বিস্ফোরণের আশঙ্কা নিয়ে দিন কাটাচ্ছি। মাঝে মাঝে অভিযান হয়, কিন্তু কিছুদিন পর আবার আগের মতোই চলে। অভিযান প্রশাসনের দায় সারা ছাড়া কিছুই না।

একাধিক সূত্র ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এসব মিনি তেল পাম্পে কোন প্রকার নিযম নীতি নেই, যে কোনো সময় বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা রয়ে়ছে। বিশেষজ্ঞদের দাবী,প্রয়োজন কঠোর পদক্ষেপ ও টেকসই পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। শুধুমাত্র অভিযান নয়, পদ্ধতিগত ও সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করে সমস্যার সমাধান ও বাস্তবায়নের জন্য তারা ৫ টি দাবী উপস্থাপন করছেন  ১) অবৈধ মিনি পাম্পগুলো চিহ্নিত করে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি নিশ্চিত করা। ২) টাস্কফোর্স গঠন করে ফায়ার সার্ভিস, বিস্ফোরক পরিদপ্তর ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সমন্বয়ে নিয়মিত মনিটরিং করা । ৩) শুধুমাত্র ট্রেড লাইসেন্সের ভিত্তিতে তেল বিক্রিকে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা। ৪) জনসচেতনতা মূলক গণমাধ্যম, সামাজিক সংগঠন ও প্রশাসনের যৌথভাবেপ প্রচার প্রচারনা কার্যক্রম পরিচালনা করা ।৫) বৈধ ফিলিং স্টেশনগুলোর সেবার মান উন্নত করা।

ডিমলা ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদ বলেন, এসব মিনি পাম্পে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র, বালুর বস্তা বা নিরাপদ দূরত্ব কিছুই নেই। আগুন লাগলে তা ভয়াবহ রুপ নিতে পারে ।

পরিবেশ অধিদপ্তর নীলফামারীর সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল্যা আল মামুন বলেন, খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে পরিদর্শন করে এসব অবৈধ পেট্রোল পাম্প  বন্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানালেও বাস্তবে এর কোনো কার্যকরী উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

বিশিষ্টজনদের মতে, ডিমলায় অবৈধ মিনি পাম্পের বিস্তার কেবল আইনের লঙ্ঘন নয়, এটি জননিরাপত্তা ও পরিবেশের জন্য এক মারাত্মক হুমকি। এই সংকট সমাধানে প্রশাসন, সংশ্লিষ্ট দপ্তর এবং জনগণের সম্মিলিত উদ্যোগই হতে পারে উত্তরণের একমাত্র উপায়। কঠোর আইন প্রয়োগ, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সুশাসনের মাধ্যমেই এই সমস্যার দীর্ঘমেয়াদী সমাধান করতে হবে ।

ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইমরানুজ্জামান বলেন, অবৈধ মিনি পাম্পগুলো চিহ্নিত করে কয়েকটিতে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে জরিমানা ও বন্ধ করে দেয়া হয়েছ।  যত দ্রুত সম্ভব আবারো ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করা হবে। জননিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখা হচ্ছে ।

 

সর্বশেষ

জনপ্রিয়

// Set maxWidth